Total Pageviews

Monday, December 17, 2018

Riders to the Sea by John Millington Synge - Full Bangla Translation - রাইডারস টু দ্যা সি - জন মিলিংটন সিঞ্জ - সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ


সম্মান ২য় বর্ষের আমার অন্যান্য লেখা গুলো দেখতে এখানে যান 


riders to the sea by j. m. synge bangla translation


Riders to the Sea by John Millington Synge -  Full  Bangla Translation - রাইডারস টু দ্যা সি - জন মিলিংটন সিঞ্জ - সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ 
চরিত্র
মোরিয়া, প্রৌঢ় রমণী
বার্টলি, তার পুত্র
ক্যাথলিন, তার কন্যা
দৃশ্যপট : পশ্চিম আয়ারল্যাণ্ডের একটি দ্বীপ ।

কুটির-হেঁসেল; জাল, ত্রিপল, চরকা, দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা কিছু তুন তক্তা ইত্যাদি। ময়দা মাখিয়ে কেক তৈরি করে বিশ বছর বয়সী ক্যাথলিন তা সেকার জন্য ন্দুরে তুলে দেয়। হাত মুছে নিয়ে ও চরকায় সুতা কাটায় মনোযোগী হয়কিশোরী নোরা দরজায় মাথা গলায় ।
নোরা : [নিচু স্বরে] কোথায় সে?  
ক্যাথলিন : শুয়ে আছে, পারলে হয়তো ঘুমুচ্ছে । ঈশ্বর তার সহায় হোক।
[ধীর পায়ে নোরা প্রবেশ করে এবং গায়ে জড়ানো শালের নিচে থেকে একটা
পুটলি বের করে ৷]
ক্যাথলিন : [চরকায় দ্রুত লয়ে সুতা কাটতে কাটতে।] কী ওটা?
নোরা : তরুণ পাদ্রী এটা বয়ে এনেছেন। ডোনেগালে ডুবে যাওয়া একজনার শার্ট আর মোজা আছে এতে। [ক্যাথলিন চমকে চরকা বন্ধ করে এবং শোনার জন্য খুকে আসে]
নোরা : দেখতে হবে এগুলো মাইকেলের কি-না; এক সময় সে সাগরের তীরে খুঁজবে।
ক্যাথলিন : মাইকেলের কী করে হবে, নোরা? অদ্দূর উত্তরে ও কী করে যাবে?
নোরা : তরুণ পাদ্রী মশাই বলেছেন, এমন অনেক ঘটনার তিনি সাক্ষী। বললেন, যদি এগুলো মাইকেলের হয় তবে তাকে বলতে পারো ঈশ্বরের কৃপায় ওর সুন্দর সৎকার হয়েছে; আর না হলে এ-ব্যাপারে তাকে কেউ যেন কিছু না বলে, কেননা কেঁদে কেঁদে শোকে অনুতাপে সে মরে যাবে ।
[নোরার ভিড়িয়ে রাখা দরজাটা দমকা বাতাসে খুলে যায়]
ক্যাথলিন : [চিত্তাক্লিষ্টভাবে বাইরে তাকিয়ে] তুই কি তাকে জিগ্যেস করেছিলি, আজ বার্টলিকে ঘোড়া নিয়ে গলওয়ে মেলায় যেতে তিনি বারণ করবেন কি-না?
নোরা : তিনি বলেছেন, ওকে আমি বাধা দেব না। কিন্তু তোমরা ভীত হয়ো না। সে তো মাঝরাত অব্দি প্রার্থনা করবে; সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তার শেষ জীবিত ছেলেকে কেড়ে নিয়ে তাকে খালি করবেন না।"
ক্যাথলিন : শাদা টিলাগুলোর কাছে সাগর কি ফুসছে, নোরা?
নোরা : মাঝারি রকম, ঈশ্বর আমাদের সহায় হোন। পশ্চিমে ভয়ঙ্কর গর্জন, স্রোত বাতাসের মুখোমুখি এলে সাগর হয়ে উঠবে আরো মারাত্মক। [পুটলি নিয়ে নোরা টেবিলের কাছে যায়] এটা এখন খুলবো?
ক্যাথলিন : এটা খুলতে খুলতে সে হয়তো জেগে উঠবে, আর কাজ সারার আগেই এখানে এসে পড়বে। [টেবিলের কাছে এসে] তাছাড়া আমরা দুজনাই কাঁদছি। এতে করে ঢের বেশি সময় লাগবে।
নোরা : [ভেতরের দরজার কাছে গিয়ে কান পাতে] সে বিছানায় নড়াচড়া করছে। এই এলো বলে!
ক্যাথলিন : মইটা নিয়ে আয়; আমি এগুলো ওপরের মাচায় এমনভাবে রাখবো। যে সে কিছু বুঝতেই পারবে না। স্রোত ঘুরলে পরে সে হয়তো বেরিয়ে পড়বে, পুব থেকে ও ভেসে আসে কিনা দেখতে।
[তারা মইটা চিমনির দেয়ালে রাখে; ক্যালিন কয়েক ধাপ উঠে পুটলিটা মাচায় লুকিয়ে ফেলে। অন্দর মহল থেকে মোরিয়া এগিয়ে আসে।]
মোরিয়া :[ক্যাথলিনের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে] আজ দিন-রাত চলার মতো খড় কি নেই?
ক্যাথলিন : কিছুক্ষণ হলো তন্দুরে কেক সেঁকতে দিয়েছি, [খড় ছুঁড়ে মারে] স্রোত ঘুরলে বার্টলি কনেমারা গেলে ওর লাগবে।
[নোরা খড় কৃড়িয়ে তন্দুরের চারধারে গুছিয়ে রাখে।]
মোরিরা : [আগুনের কাছে একটা টুলে বসে] দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে বাতাস উঠছে। ও আজ যাবে না। নিশ্চয় পাদ্রী ওকে ফেরাবেন।
নোরা : না মা, তিনি ওকে থামাবেন না; ইমন সায়মন, স্টিফেন ফিটি, কোলাম শ্যন ওরা বলাবলি করছিলো, ও যাবে।
মোরিয়া : ও কোথায়?
নোরা : এ-সপ্তায় আর কোনো নৌকা নোঙর তুলবে কি-না দেখতে গেছে। মনে হচ্ছে শিগগিরই ফিরবে। কেননা সবুজ উপদ্বীপে স্রোত বাক নিচ্ছে এবং নৌকাটা পাল ঘুরিয়ে পুব থেকে দিক বদলাচ্ছে।
ক্যাথলিন : কে যেন বড় পাথরগুলো পেরিয়ে আসছে। নোরা বাইরে তাকিয়ে। ও আসছে, ওকে ব্যস্ত মনে হচ্ছে।
বার্টলি : [ভেতরে ঢুকে ঘরময় চোখ বুলিয়ে নেয়; ধীর, বিষন্ন সুরে বলে] কনেমারায় কেনা নতুন রশিটা কোথায়, ক্যাথলিন?
ক্যাথলিন : [নেমে এসে ] ওকে ওটা দে, নোরা; শাদা তক্তার কাছে পেরেকে ঝোলানো আছে। আজ সকালে ওখানে রেখেছি, কেননা কালো-পায়ের শুয়োরটা ওটা খাচ্ছিলো।
নোরা : [বার্টলিকে রশিটা দিয়ে] এটাই তো, বার্টলি?
মোরিয়া : রশিটা যেমন ছিলো তেমনি রাখলেই ভালো করবি, বার্টলি! [বার্টলি রশিটা নেয়] আমি বলছি, ওটা এখানে লাগবে। কাল সকাল কিংবা পরশু সকাল বা সপ্তার যে কোনো দিন সকালে মাইকেলের দেহ ভেসে এলে ঈশ্বরের কৃপায় ওকে একটা বড় কবরে শুইয়ে দেবো।
বার্টলি : রশিটা নিয়ে কাজ করতে শুরু করে। ঘুড়ীটাতে চড়তে যে লাগাম লাগে, তা আমার নেই এবং আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে। সামনের দু-তিন সপ্তা মধ্যে কোনো নৌকা নেই। আমি ওদের বলতে শুনেছি ঘোড়ার জন্য এবার ভালো দাম পাওয়া যাবে।
মোরিয়া : লোকে কী বলবে! কনেমারা থেকে এত দামে শাদা তক্তা আনালাম, অথচ কফিন বানাবার জন্যে কেউ থাকবে না।[তক্তাগুলোর দিকে সে তাকায়।]
বার্টলি : কিভাবে লাশ ভেসে আসবে? নয় দিন হয়ে গেলো। আজ আবার পশ্চিম-দক্ষিণ দিক থেকে জোর বাতাস বইছে।
মোরিয়া : না-ইবা পেলাম। বাতাস সমুদ্রকে জাগিয়ে তুলছে, রাতের আকাশে চাঁদের বিপরীতে ছিলো এক তারা। তোর একশ' ঘোড়া বা হাজার ঘোড়া থাকলেও যেখানে একটি মাত্র ছেলে বেচে, সেখানে তার বদলে হাজার ঘোড়ার মূল্যে আমার কী হবে?
বার্টলি : [লাগাম বানাতে বানাতে ক্যাথলিনকে] তুই কিন্তু প্রতিদিন নেমে গিয়ে দেখবি যাতে ভেড়ার পাল ফসল বরবাদ না করে, আর ফড়িয়া ভালো দাম দিলে। কালো-পায়ের শুয়োরটা বেচে দিস।
মোরিয়া : ওর মতো মেয়ে কী করে শুয়োরের জন্য ভালো দাম পাবে?
বার্টলি : পশ্চিমা বাতাস যদি অমাবস্যাতক এমনভাবে বইতে থাকে তবে নোরাকে নিয়ে তুই আর এক টাল আগাছা কুড়াবি ক্ষার করার জন্য। কপাল খারাপ, আজ থেকে এ-সংসারে একজন পুরুষ ছাড়া কাজ করার আর কেউ রইলো না।
মোরিয়া : অন্যদের মত তুইও যেদিন ডুবে মরবি সেদিন একেবারেই আমাদের কপাল পূড়বে। আমার বয়স হয়েছে, একপা আমার কবরে, মেয়েদেরকে নিয়ে কীভাবে বাঁচবো। [লাগামটা রেখে বার্টলি পুরনো কোট ছেড়ে একই ফ্লানেলের তৈরি নতুন কোটটা পরে নেয়]
বার্টলি : [নোরাকে] নৌকা কি ঘাটে আসছে?
নোরা :[বাইরে তাকিয়ে] উপদ্বীপ পেরোচ্ছে আর পাল নামিয়ে নিচ্ছে।
বার্টলি : [টাকার থলে এবং তামাক নিয়ে] আধঘণ্টার মধ্যে ঘাটে পৌছতে হবে। ফিরতে দুদিন বা তিন দিন বা আবহাওয়া খারাপ থাকলে চার দিনও লাগতে পারে।
মোরিয়া : [আগুনের দিকে ঘুরে মাথায় শাল চড়িয়ে] কী কঠোর, কী নির্মম! একজন বুড়ির একটা কথাও শুনছে না, যে কি-না তাকে সমুদ্র থেকে বাঁচাতে চাইছে।
ক্যাথলিন : জোয়ান ছেলের জীবনই তো সাগরে যাবার জন্যে। তাছাড়া একজন বুড়ির ঘ্যানঘ্যানই বা কে শোনে?
বার্টলি : [লাগাম নিয়ে] এক্ষুনি আমাকে বেরুতে হচ্ছে, লাল ঘুড়ীটায় চড়ে আমি যাবো, পেছন পেছন দৌড়বে ছাই-রঙা টাট্টুটা ...... ঈশ্বর তোমাদের সহায় থাকুন [ও বেরিয়ে যায়। ]
মোরিয়া :[ও দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই কেঁদে ওঠে] চলে গেলো, ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন, ওর সাথে আর দেখা হবে না। ও চলে গেলো। আসছে অমাবস্যায় আমার আর একটা ছেলেও পৃথিবীতে থাকবে না।
ক্যাথলিন : দরজায় দাড়িয়ে ও যখন ফিরে তাকালো তখন ওকে আশীর্বাদ করলে না কেন? বাড়ির সব কটা প্রাণীই তো বিষণ্ণ; অমন অশুভ, নির্মম কথা ওর বিদায় মুহুর্তে শুনিয়ে দিলে [চিমটা দিয়ে মোরিয়া উদ্দেশ্যহীনভাবে একমনে আগুন নাড়ায়।
নোরা : [ তার দিকে ফিরে] তুমি কেক থেকে জ্বালানি সরাচ্ছো।
ক্যাথলিন : [কেদে ওঠে] ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করুন, নোরা। আমরা ওকে কেকটা দিতে ভুলে গেছি। [সে আগুনের কাছে আসে।]
নোরা : সারারাত ও বাইরে থাকবে। সকাল থেকে ওর পেটে কিছুই পড়ে নি। ও মারা পড়বে।
ক্যাথলিন : [তন্দুর থেকে কেকটা নিয়ে] অবশ্যিই ও মারা যাবে। যে বাড়িতে একজন বুড়ি সবসময় ঘ্যানঘ্যান করছে সেখানে কারো মাথা ঠিক থাকতে পারে না।
[মোরিয়া টুলে দুলতে থাকে।]
ক্যাথলিন : [কেকের কিছুটা কেটে একটা কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে, মোরিয়াকে] এক্ষুনি এটা নিয়ে তুমি ঝর্না-কূপের কাছে গিয়ে ওকে দাও। ওর সাথে তোমার দেখা হবে, দূর হবে অশুভ কথার অভিশাপ। ওর মনটা সুস্থির করতে তুমি বলতে পারো, তোর যাত্রা শুভ হোক।"
মোরিয়া : [কেকটা নিয়ে] আমি কি ওকে ধরতে পারবো?
ক্যাথলিন : এখনই দ্রুত বেরিয়ে পড়লে, পারবে।
মোরিয়া : [টলটলায়মান] পোড়া কপাল, আমার হাটতে হচ্ছে।
ক্যাথলিন : [উদ্বিগ্নভাবে তার দিকে তাকিয়ে] ছড়িটা দে, নোরা, নইলে হয়তো সে বড় পাথরগুলোয় পিছলে যাবে।
নোরা : কোন্ ছড়ি?
ক্যাথলিন : কনেমারা থেকে মাইকেল যেটা এনেছিলো।
মোরিয়া : [নোরার কাছ থেকে ছড়িটা নিয়ে] বড় পৃথিবীটায় সবখানে বুড়োরা তাদের ছেলেপিলেদের জন্য সম্পত্তি রেখে বিদায় নেয়, আর এখানে বাচ্চারাই বুড়োদের জন্য সব ছেড়ে চলে যায়। [ধীরে ধীরে সে বেরিয়ে যায়। নোরা মইটার কাছে যায়]
ক্যাথলিন : একটু পরে, নোরা, সে হয়তো এক্ষুনি ফিরে আসবে। ঈশ্বর তাকে সাহায্য করুন, এতটাই সে মর্মাহত যে কী করে বসে, বলা মুশকিল।
নোরা : সে কি ঝোপটা পেরিয়েছে?
ক্যাথলিন : এখন চলে গেছে। জলদি ওটা ফেলে দে, ঈশ্বর জানেন, আবার এসে পড়ে কি-না।
নোরা : [মাচা থেকে পুটলিটা নামাতে নামাতে] পাদ্রী জানিয়েছেন, কাল এ-পথে তিনি যাবেন, যদি এগুলো নিশ্চিতভাবে মাইকেলের হয় তবে তাকে বলতে বলেছেন।
ক্যাথলিন : [পুটলিটা নিয়ে] এগুলো কী করে পাওয়া গেছে তা কি বলেছেন?
নোরা : [নামতে নামতে]দু'জন লোক খুব ভোরে চোরাই মদ নিয়ে দাড় টানছিলো। উত্তরের কালো চূড়াটা পেরোবার সময় একজনার দাড়ে মড়াটা জড়িয়ে যায়, বললেন পাদ্রী।
ক্যাথলিন : [পুটলিটা খুলতে চেষ্টা করে] চাকুটা আতো, নোরা; দড়িটা নোনা পানিতে বসে গিয়ে এমন একটা কালা গিট পড়েছে যে সারা সপ্তাতুই এটা খুলতে পারবি না।
নোরা : [ওকে ছুরি দিয়ে] আমি তো শুনেছি ডোনেগাল না-কি অনেক দূর।
ক্যাথলিন : [দড়ি কেটে নিশ্চয়] কয়েকদিন আগে এখানে যে লোকটা এলোচাকুটা বেচলো যে আমাদের কাছে--বললো, পাহাড়গুলোর কাছ থেকে হাটা শুরু করলে ডোনেগালে পৌছতে সাত দিন লাগবে।
নোরা : কিন্তু লাশ ভেসে গেলে কদিন লাগবে?
[ক্যাথলিন পুটলি খুলে একটি শার্টের টুকরো এবং মোজা বের করে। ওরা ওগুলো কৌতুহলের সাথে দেখে।]
ক্যাথলিন : [নিচু স্বরে] প্রভু আমাদের রক্ষা করুন, নোরা এগুলো মাইকেলের কি-না, তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন নয় কি?
নোরা : দাড়া, আমি হুক থেকে ওর শার্টটা নিয়ে আসি, তাহলে দু'টো ফ্রানেল মিলিয়ে দেখা যাবে।[এক পাশে ঝুলন্ত কিছু কাপড় সে নেড়েচেড়ে দেখে] কই, ওটাতো এখানে নেই। কোথায়, ক্যাথলিন?
ক্যাথলিন : মনে পড়েছে, বার্টলি আজ ভোরে ওটা পরেছে, কেননা ওর নিজের শার্টটা লবণ লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। [কোনার দিকে নির্দেশ করে] একই কাপড়ের তৈরি জামার আস্তিনের কিছুটা ওখানে আছে। নিয়ে আয়, ওতে হবে। [নোরা ওটা নিয়ে আসে এবং ওরা দুটো মিলিয়ে দেখে]
ক্যাথলিন : একই কাপড়, নোরা; তা হলেও গলওয়ের দোকান গুলোতে ঐ কাপড়ের কি বড় বড় থান থাকতে পারে না? আর মাইকেলের মতো আরো অনেকেরই কি অমন শার্ট থাকতে পারে না?
নোরা : [মোজাটি নিয়ে সেলাই গুনে, আর্তনাদ করে ওঠে] এটা মাইকেলের, ক্যাথলিন, মাইকেলের; ঈশ্বর ওর আত্মার মঙ্গল করুন, সে জানলে কী হবে, আবার বার্টলি এখন সাগরে।
ক্যাথলিন : মোজাটা নিয়ে। এটা তো একেবারে সাধারণ মোজা।
নোরা : যে তিন জোড়া মোজা আমি বুনেছি এটা তার দ্বিতীয়টি, আমি তিন-কুড়ি ঘর বুনেছিলাম এবং চার ঘর বাদ দিয়েছিলাম।
ক্যাথলিন : [গণনা করে] হ্যা, এটাই এটাই! [কেঁদে] আহ, নোরা, ভাবা যায়? ও দূর উত্তরে ভেসে গেলো আর সাগরের উড়ুক্কু কালো ডাইনিরা ছাড়া ওর জন্যে বিলাপ করার কেউ রইলো না?
নোরা : [দুলতে দুলতে অর্ধেক ঘুরে কাপড়-চোপড়গুলো বাহুপাশে এনে] কী ভীষণ মর্মান্তিক! দাঁড় টানায়, মাছ ধরায় এমন পটু মানুষটার জামার একটা টুকরা আর মোজা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই!
ক্যাথলিন : [মুহূর্ত খানেক থেমে] সে আসছে কি, নোরা? পথে যেন আওয়াজ শুনলাম!
নোরা : বাইরে দৃষ্টি মেলে। হা, সে-ই, ক্যাথলিন। দরজা পর্যন্ত এসে গেছে।
ক্যাথলিন : [মুহূর্ত খানেক থেমে] সে আসার আগেই এগুলো সরিয়ে ফেলো বার্টলিকে আশীর্বাদ করার পর সে বোধ হয় স্বস্তি বোধ করছে, সাগর থেকে ওর ফেরার আগে তাকে আমরা কিছু জানতে দেবো না।
নোরা :পুটলি বাঁধতে ওকে সাহায্য করে। এগুলো এ-কোনায় রেখে দি। চিমনির কোনায় একটা গর্তে ওগুলো ওরা রেখে দেয়। [ক্যাথলিন চরকার কাছে ফিরে যায়।]
নোরা : আমি কাদছিলাম, সে কি বুঝতে পারবে?
ক্যাথলিন : দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে থাক, যাতে মুখে আলো না পড়ে। [দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে নোরা চিমনির কোনায় বসে পড়ে। মোরিয়া অতি ধীরে প্রবেশ ক'রে মেয়েদের দিকে না তাকিয়ে আগুনের পাশে রাখা টুলের দিকে যায়। কাপড়ে মোড়া কেকটা এখনো তার হাতে । মেয়েরা চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে এবং নোরা কেকের দিকে ইঙ্গিত করে।
ক্যাথলিন : [চরকায় মুহূর্তখানেক সুতা কেটে] তুমি ওকে কেকটা দাওনি? [না ঘুরেই মোরিয়া মৃদুভাবে বিলাপ করতে থাকে।]
ক্যাথলিন : তুমি কি ওকে যেতে দেখেছিলে? [মোরিয়া বিলাপ করতেই থাকে।]
ক্যাথলিন : [একটু অস্থির হয়ে] ঈশ্বর তোমায় ক্ষমা করুন; ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে কান্নাকাটি করার চেয়ে যা দেখেছো স্পষ্ট তা বলাটা কি ভালো নয়? আমি বলি, বার্টলির সাথে তোমার কি দেখা হয়েছে?
মোরিয়া : [দুর্বল কণ্ঠে] আজ আমার বুক ভেঙে গেলো।
ক্যাথলিন : [আগের মতোই] বার্টলিকে তুমি দেখেছো?
মোরিয়া : আমি সবচাইতে ভয়ঙ্কর জিনিস দেখেছি।
ক্যাথলিন : [চিরকা ছেড়ে বাইরে তাকায়] ঈশ্বর তোমায় ক্ষমা করুন; ও তো এখন উপদ্বীপের ওপর দিয়ে ঘুড়ীতে চেপে যাচ্ছে, ও পেছনে টাট্টুটা।
মোরিয়া : [চমকে ওঠায় মাথা থেকে শাটা পড়ে যাওয়ায় তার শাদা এলোমেলো চুল নজরে পড়ে। ভয়ার্ত কন্ঠে] ছাই-রঙা টাট্টুটা ওর পেছনে .....
ক্যাথলিন : [আগুনের কাছে এসে] কী তোমাকে এত পীড়া দিচ্ছে।
মোরিয়া : [খুবই ধীরে কথা বলতে বলতে ] নববধূ ডারা ছেলে-কোলে মৃত ব্যক্তির যে ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছিলো, তারপর আর কেউ আমার মতো এমন ভয়ানক দৃশ্য দেখে নি।
ক্যাথলিন এবং নোরা : কী বলছো?
[বৃদ্ধার সামনে হাঁটু গেড়ে ওরা বসে পড়ে।]
নোরা : কী দেখেছো আমাদের বলো ।
মোরিয়া : ঝর্নাকূপের কাছে গিয়ে আমি মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম । লাল ঘুড়ীটায় চেপে তারপর বার্টলি এলো, পেছনে ছাই-রঙা টাট্টুটা। [কিছু একটা না দেখতে চেয়ে যেন সে হাত তুলে চোখ ঢাকে ] ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন, নোরা।
ক্যাথলিন : কী তুমি দেখেছো।
মোরিয়া : মাইকেলকে ।
ক্যাথলিন : [নম্রভাবে] না মা, তুমি মাইকেলকে দেখোনি। ওর লাশ বহুদু উত্তরে পাওয়া গেছে, ঈশ্বরের দয়ায় ওর সৎকার সুন্দরভাবেই হয়েছে।
মোরিয়া : [একটু বেপরোয়াভাবে] আমি আজই ওকে টাট্টুতে চেপে যেতে দেখেছি। ঘুড়ীটায় চড়ে প্রথম এলো বার্টলি, আমি ওকে বলতে চাইলাম তোর যাত্রা শুভ হোক; কিন্তু কথাগুলো গলায় আটকে গেলো। "ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন" বলে ও দ্রুত চলে গেলো, আমি কিছুই বলতে পারলাম না। তারপর মুখ তুলে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দেখলাম ছাই-রঙা টাট্টুটার ওপরে ঘসে আছে মাইকেল পরনে ওর পরিপাটি কাপড়, পায়ে নতুন জুতো।
ক্যাথলিন : [বিলাপ শুরু করে] আজ থেকে আমরা শেষ হয়ে গেলাম। একেবারে শেষ হয়ে গেলাম ।
নোরা : পাদ্রী কী বলেন নি, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তার একমাত্র জীবিত পুত্রকে কেড়ে নিয়ে তাকে খালি করবেন না।
মোরিয়া : [নিচু স্বরে কিন্তু স্পষ্টভাবে] ও সাগরের কী জানে! বার্টলিও এখন হারিয়ে যাবে। তোরা ইমনকে ডেকে নিয়ে আয়, আমার জন্য শাদা তক্তাগুলো দিয়ে ও কফিন বানাক; কেননা এরপর আমি আর বাঁচতে চাই না। আমার স্বামী ছিলো শ্বশুর ছিলো, ছিলো তরতাজা ছয়টি ছেলেপ্রত্যেকের জন্মের সময় আমি অসহ্য কষ্ট সয়েছি। তাদের কয়েকজনার লাশ পাওয়া গেছে, কয়েকজনার পাওয়া যায়নি, কিন্তু তাদের সবাই আজ হারিয়ে গ্যাছেপ্রত্যেকেই । তুফানে পড়ে ষ্টিফেন আর শ্যন হারিয়ে গেলো পরে গোল্ডেন মাউথের উপসাগরে মিললো ওদের লাশ। একই তক্তায় ক'রে ওদের বয়ে আনা হয়েছিলো, ঐ দরজা দিয়ে।
[সে কিছুক্ষণের জন্য থামে, মেয়েরা চমকে ওঠে। পেছনের ভেজানো দরজা দিয়ে ওরা কী যেন শুনতে পেয়েছে।]
নোরা : [ফিসফিসিয়ে] সাগর-পারে কে যেন কাঁদছে!
মোরিয়া : [কিছু না শুনে বলে চলে]এক কালো রাতে ভেসে গেলো শীমাস, তার বাবা এবং তার বাবা। সূর্য উঠলে পরে ওদের কোনো চিহ্নই মিললো না। এরপর নৌকা উল্টিয়ে মরলো প্যাচ। বার্টলি তখন বাচ্চা, আমি ওকে কোলে করে ব'সেছিলাম। দুজন, তিনজন, চারজন করে মেয়েলোক এসে চুপচাপ ক্রুশ দেখিয়ে যাচ্ছিলো। বাইরে তাকিয়ে তখন দেখলাম, ওদের পেছনে আসছে পুরুষরা, হাতে তাদের অর্ধেক লাল পালে মোড়ানো কিছু একটা যা থেকে ফোটায় ফোঁটায় জল ঝরছিলোসেদিনটা ছিলো একবারে খটখটে শুকনো, নোরাদরজা পর্যন্ত ছিলো জলের চিহ্ন।
[দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে সে থামে। আস্তে আস্তে দরজা খুলে যায়, বৃদ্ধারা দোরগোড়ায় ক্রুশ দেখাতে দেখাতে ভেতরে ঢুকে মাথার ওপরে লাল কাপড় জড়িয়ে মঞ্চে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।]
মোরিয়া : [যেন স্বপ্নে, ক্যাথলিনকে] প্যাচ, নাকি মাইকেল, নাকি আর কিছু?
ক্যাথলিন : মাইকেলের লাশ বহু দূর উত্তরে পাওয়া গেছে, কী করে ও এখানে। আসবে?
মোরিয়া : যুবকদের ক্ষমতা আছে বোধ হয় লাশ হয়েও ইচ্ছে মতো ভেসে বেড়ানোর, আর এটা মাইকেলেরই না অন্য কারো তাই বা ওরা কীভাবে বুঝবে। নয়দিন সাগরে থাকলে আর এমন বাতাস হলে, স্বয়ং মা-ও বলতে পারবে না ওটা ওরই ছেলের কি-না।
ক্যাথলিন : কোনো সন্দেহ নেই, ওটা মাইকেলেরই লাশ, কেননা ঐ দূর উত্তর থেকে ওরা কিছু কাপড়-চোপড় পাঠিয়ে দিয়েছে; ঈশ্বর ওকে রক্ষা করুন।
[হাত বাড়িয়ে সে মাইকেলের বস্ত্রগুলো মোরিয়ার হাতে দেয়। ধীরে ধীরে মোরিয়া উঠে দাঁড়ায় এবং ওগুলো হাতে নেয়। নোরা বাইরে তাকায়।]
নোরা : ওরা কিছু একটা বয়ে আনছে, যা থেকে ফোটায় ফোটায় জল ঝরছে; বড় পাথরগুলোর গায়ে চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে।
ক্যাথলিন : [আগত নারীদের উদ্দেশে চুপিচুপি] বার্টলি!
একজন নারী : নিঃসন্দেহে, ঈশ্বর ওর আত্মার মঙ্গল করুন।[দুজন যুবতী ঘরে ঢুকে টেবিলটা বের করে আনে। তারপর পুরুষরা তক্তায় চাপানো পালে জড়ানো বার্টলির লাশটা টেবিলের ওপর রাখে।
ক্যাথলিন : [কর্মরত মহিলাদের উদ্দেশে]কীভাবে ডুবলো ও?
একজন নারী : ছাই-রঙা টাট্টুটা ওকে ধাক্কা দিয়ে সাগরে ফেলে দেয় এবং শাদা টিলা গুলোর কাছে যেখানে সমুদ্রের বিরাট বিরাট ঢেউ আছড়ে পড়ছে সেখানে ওর লাশ ভেসে ওঠে ।
মোরিয়া লাশটার কাছে গিয়ে টেবিলের মাথায় হাঁটু গেড়ে বসে। মৃদু স্বরে নারীরা সামান্য দুলে দুলে বিলাপ করতে থাকে। ক্যাথলিন এবং নোরা টেবিলের অপর প্রান্তে হাঁটু গেড়ে বসে। পুরুষরা দরজার কাছে হাঁটু দেয়।
মোরিয়া : কাউকে যেন দেখছে না এমনভাবে মাথা উঠিয়ে। ওরা সবাই হারিয়ে গেলো, সমুদ্র আর এখন আমার কিছুই করতে পারবে না, .... দক্ষিণ দিক চিরেখন তুফান আলোড়ন তুলবে, পুব-পশ্চিমের দামাল ঢেউগুলো ভীষণ শব্দে এ-ওকে আঘাত করবে, তখন আমাকে কেঁদেকেটে আর প্রার্থনা করতে হবে না। বেরিয়ে পড়তে হবে না সামাইনের[] পর অমানিশায় পবিত্র জল সংগ্রহে; অপর মহিলারা যখন বিলাপ করবে তখন সাগরের কথা আর আমায় ভাবতে হবে না। [নোরার প্রতি] পবিত্র জলের বয়ামটা আন তো, নোরা।
[নোরা তাকে ওটা দেয়।]
মোরিয়া : [বার্টলির পায়ের কাছে মাইকেলের কাপড় ফেলে সে লাশটিতে পবিত্র জল ছিটিয়ে দেয় বার্টলি, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে তোর জন্যে প্রার্থনা করি নি এমন নয়। কালো রাতের প্রার্থনায় কী বলেছি তা তুই জানবি না, কিন্তু প্রার্থনা করিনি, তা তো নয়। আজ আমি গভীর বিশ্রাম নেবো , বিশাল বিশ্রামের সময় হয়েছে। স্যামাইনের পর দীর্ঘ রজনীতে নিঃসাড় ঘুমে ঢলে পড়বো, যদি শুধু জোটে মাত্র বাসি রুটি আর পচা মাছ। [সে হাঁটু গেড়ে বসে ক্রুআঁকে এবং বিড়বিড় করে প্রার্থনা করতে থাকে।]
ক্যাথলিন : [একজন বৃদ্ধকে ] তুমি আর ইমন ভোরে একটা কফিন বানিয়ে দেবে। মাইকেলের কথা ভেবে মা সুন্দর কিছু তক্তা আনিয়েছে, ঈশ্বর ওকে সাহায্য করুন। কাজ করতে করতে তোমরা আমার তৈরি নতুন কেকটা খেতে পারবে। মোরিয়া আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে মাইকেলের কাপড়চোপড় লাশটার পাশে মেলে ধরে শেষ পবিত্র জলটুকু ছিটিয়ে দেয়।
নোরা : [চুপিচুপি ক্যাথলিনক] সে এখন শান্ত, সুস্থির; কিন্তু মাইকেল যেদিন হারিয়ে গেলো, সেদিন তার সে কী চিৎকার! ঝর্না-কূপ থেকেও হয়তো শোনা গেছে। সে মাইকেলকেই বেশি ভালোবাসতো, কেউ কি ভেবে দেখেছে?
ক্যাথলিন : [ধীরে ও স্পষ্টভাবে] যে কোনো কাজেই একজন বুড়ি তো জলদি ক্লান্ত হয়ে পড়বেই, আর তাছাড়া সে কি গত নদিন কান্নাকাটিতে বাড়িটাকে একেবারে আচ্ছন্ন করে রাখে নি?
মোরিয়া : [শুন্য বয়ামটিকে টেবিলের ওপর উল্টিয়ে রেখে; বাটলির পায়ে হাত রেখে] জীবন- লীলা শেষে আজ ওরা সবাই এক হয়েছে। পরমেশ্বরের কৃপাধারা বার্টলির আত্মার ওপর বর্ষিত হোক; করুণা বর্ষিত হোক মাইকেল, শীমাস, প্যাচ, স্টিফেন আর শ্যনের আত্মার ওপর; [মাথা নুইয়ে] তার দয়ায় সিক্ত হোক আমার, নোরার, পৃথিবীর সকল জীবিত মানুষের আত্মা।
[সে থামে, মহিলাদের বিলাপের ধ্বনি বেড়ে ওঠে কিছুটা, তারপর মিলিয়ে যায় ।
মোরিয়া : [আবার বলতে থাকে] সুদূর উত্তরে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কৃপায়। মাইকেলের সুন্দর সৎকার হয়েছে। বার্টলির জন্য শাদা তক্তা দিয়ে সুন্দর কফিন বানানো হবে, নিশ্চয় একটি গভীর কবরে ও ঠাই পাবে। এর চেয়ে বেশি আর আমরা কী চাই? চিরকাল কেউ বাঁচে না, আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
[সে আবার হাঁটু গেড়ে বসে। ধীরে ধীরে পর্দা নামে ।]


১। মৃত্যুলোকের পর্ব, ১ নভেম্বর

Maruf 

3 comments: